জেলা প্রতিনিধি, বগুড়া: বগুড়া সদর উপজেলার নিশিন্দারা ইউনিয়নের বারোপুর তালুকদার পাড়ার হোচিমিন একজন সফল মানুষ। তবে ট্রান্সজেন্ডার নারীর পরিচয়ের কারণে গত মার্চ মাসের শেষদিকে এলাকায় তার পরিবারকে একঘরে করে রাখার প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর এই প্রক্রিয়াটি শুরুর পেছনে কলকাঠি নাড়ার অভিযোগ উঠেছে হোচিমিনেরই চাচা সম্পর্কীয় প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে।
পরিবারে কোনো পুরুষ নেই এমন অযুহাত দেখিয়ে হোচিমিনদের সম্পদ দখলের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে তারই চাচার বিরুদ্ধে!
হোচিমিন ইসলাম কাজের সূত্রে ঢাকায় থাকেন। আর গ্রামের বাড়িতে থাকেন তার মা রেহেনা খাতুন ও বোন নিলুফা ইয়াসমিন। হোচিমিনের বাবা বাবুল মিয়া নৈশ প্রহরী ছিলেন। প্রায় ৯ বছর আগে তিনি মারা যান। এরপর থেকে নিলুফা ও হোচিমিনকে নিয়ে বসবাস করছিলেন তাদের মা রেহেনা খাতুন।
স্থানীয় নুনগোলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে বেসরকারি টিএমএসএস নার্সিং কলেজ স্নাতক ডিগ্রি নেন হোচিমিন। পরে ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত হন।
হোচিমিন বলেন, ‘২০২০ সালে আমি মা ও বোনকে বলে ট্রান্সজেন্ডার নারীতে নিজেকে রূপান্তরিত করি। গত বছর আমাকে নিয়ে টিভি৯বাংলা নামে একটি চ্যানেলে ডকুমেন্টারি প্রচার হয়। এ থেকে এলাকার মানুষ বিষয়টি জানতে পারে। এরপর থেকে এলাকায় আমাকে নিয়ে কটূ কথা শুরু হয়। আমার মা-বোনকে অনেকে খোঁটা দেয়া শুরু করেন।’
হোচিমিন জানান, ট্রান্সজেন্ডার নারীর বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর গত মার্চে তার মায়ের কাছে এসে সম্পত্তির ভাগ দাবি করেন চাচা রেজাউল করিম। বলেন, ‘তোমার তো এখন দুটোই মেয়ে। তাহলে নিয়ম অনুসারে ভাইয়ের অবর্তমানে আমি সম্পত্তির ভাগ পাবো।’
পরিবারটিকে একের পর এক হুমকি-ধমকি দেয়ার অভিযোগও উঠেছে রেজাউলের বিরুদ্ধে। এক পর্যায়ে থানায় জিডি করতে বাধ্য হন হোচিমিন। গত ১৩ মার্চ দুই পক্ষকেই থানায় ডেকে মীমাংসা করে দেয় পুলিশ।
হোচিমিনের অভিযোগ, সম্পদ দখলের সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় ওই মীমাংসা মেনে নেননি তার চাচা ও প্রতিবেশীরা।
হোচিমিনের মা বলেন, ‘রেজাউলকে থানায় ডাকার জন্য সেখানে তারা আমাদের দায়ী করেন। সিদ্ধান্ত হয়, পাড়ার কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারবে না। সবাইকে বলে দেয়া হয়, হিজড়ার পরিবারের সঙ্গে যেন কোনো রকম সম্পর্ক না থাকে।’
রেজাউল করিমকে সমর্থনের অভিযোগ উঠেছে ওই ইউনিয়নের সাবেক সদস্য আহসান হাবীব হারুন, স্থানীয় রাহিজুল ইসলাম তালুকদার, খায়রুল, শাহিনসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে।
হোচিমিনের বোন নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, ‘গত শবেবরাতের দিন একঘরে করার ঘোষণা দেয়ার পর আমাদের পরিবারে অশান্তি শুরু হয়। যারা আমাদের একঘরে করেছেন, তাদের বাড়ির মেয়েরা সকাল-বিকাল গালাগাল করতে শুরু করে। সব সময় তারা হোচিমিনকে নিয়ে আমাদের দোষারোপ করতে থাকে। আমার সন্তানদের সঙ্গেও অন্য বাচ্চাদের খেলাধুলো করতে দেয় না।’
নিলুফা জানান, তাদের পাড়ার দুটি দোকান থাকলেও তাদের কাছে কোনো পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে না।
হোচিমিনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ও আপসে সাক্ষি দেয়ার কারণে স্থানীয় আতাউর রহমান, শাজাহান আলী তালুকদার, লুৎফর রহমান দুদু ও ইমরুল হোসেনও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ইমরুল হোসেনের স্ত্রী নাদিরা জানান, আপস থেকে ফেরার পরের দিন তাদের বাড়ির বর্জ্য পানি যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আতাউরের বাড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল, পরে সেটি ঠিক করা হয়।
শাহাজান আলী তালুকদার বলেন, ‘বাপ মরা দুজনের হয়ে কথা বলায় আর থানায় আপসে সাক্ষি হওয়ায় আমাকেও একঘরে করা হয়েছে।’
তবে যাদের বিরুদ্ধে একঘরে করার অভিযোগ তারা বিষয়টি স্বীকার করছেন না। এদের মধ্যে অভিযুক্ত রাহিজুল তালুকদারও সম্পর্কে হোচিমিনের চাচা হন। তিনি বলেন, ‘একঘরে করার কোনো ঘটনা ঘটেনি। হোচিমিন তো মেয়েও না, ছেলেও না। ওদের বুঝানো কষ্টকর।’
সম্পত্তিতে ভাগ দাবি করার বিষয়টি স্বীকার করে হোচিমিনের চাচা রেজাউল করিম তালুকদার বলেন, ‘আমি কাউকে একঘরে করতে বলিনি। তবে মার্চ মাসে গ্রামে কথা উঠল আমাকে কেন থানায় নিয়ে যাওয়া হল। গ্রামে কেন বিচার চাইল না হোচিমিন। এ জন্য হয়তো তাদের একঘরে করতে পারে, তবে আমি এর সঙ্গে জড়িত না।’
অভিযুক্ত হারুন বলেন, ‘একঘরে তো আমি করিনি। ওরাই তো কোনো কিছু হলে থানায় জিডি, অভিযোগ করে। এসব কারণেই মহল্লাবাসী তাদের একঘরে করেছে। আমার একক কোনো সিদ্ধান্ত নয়।’
জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী বলেন, ‘হোচিমিনের বিষয়টি আমি জানি। এর আগেও তিনি আইনের সহায়তা চেয়েছিলেন। আমরা তাকে সহযোগিতা করেছিলাম। ওই সমস্যা এখনও সমাধান না হলে আমরা আবার তাকে সহযোগিতা করব।’